দাদীকে মনে পড়ে
চাইলেই সব অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না কিংবা চাইলেই সব পরিনতি মনের মত হয়না। বছরের পর বছর একসাথে থেকেও মানুষ চেনা যায়না।
জীবনের দৌড়ে সবাই জিততে পারেনা! সপ্তাহের সব দিন যেমন একরকম কাটেনা! এর মধ্যে কতগুলো শুক্রবার কেটেছে আমার কর্মস্থল আর রাজাদের শহরে যাতায়াতে। শরীরটাও বেশ ক্লান্ত। এর মধ্যে মৃত্যু দেখতে হচ্ছে একের পর এক। স্বজনদের বাড়িতে বুঝি এবার শুরু হলো যমদূতের নিয়মিত যাতায়াত! দেখতে হয়েছে মৃত্যুকে ঘিরে মানুষের আদিখ্যেতা।
দাদী বলতো, "এতো বাহাদুরি করতেছো! আজ মরলে কাল হবে সাতদিন।" আজকে দাদীর কথাটা মনে পড়ছে। দাদী মারা গেছে আজ ১৪ দিন পার হয়ে গেলো। দাদীর কবরের পাশে বসে থাকতে ভালো লাগে। দাদীকে না বলতে পারা কথাগুলো বলতে ভালো লাগে। দাদীর জন্য কিছু করার ইচ্ছে জাগে। বেঁচে থাকতে আমাদের এই অনুভূতি গুলো হয়না। কারন আমরা দুনিয়ার মোহে এতোটাই মেতে থাকি যে মৃত্যুর কথা ভুলে যাই। প্রিয় মানুষগুলো যে একদিন আমাদের ছেড়ে চলে যাবে তা ভুলে যাই।
হসপিটাল থেকে বাসায় চলে আসার জন্য আমি দাদীর উপর অনেক রাগ করেছিলাম। ২/৩ দিন কথা বলিনি। দাদী বিছানায় শুয়ে সবাইকে বলতো, "আমার নাতি আমার উপর রাগ করছে মা, একটু বলিস যেন আমার সাথে কথা বলে।" এই কথাটা আমার প্রতিদিন মনে পড়ে।
দাদী ছবি তুলতে পছন্দ করতো না। সে জন্য দাদীর সাথে আমার একক কোন ছবি নেই। দাদাকে তো দেখার সৌভাগ্যই হয়নি। মুক্তিযুদ্ধেরও আগে দাদা মারা যায়। তখন দাদীর বয়স বড়জোর ২৪-২৫ হবে। ছোটো দুটো বাচ্চা নিয়ে সেই বিধবা মেয়েটি সন্তান সংসার আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে। লড়াই করে যায় তৎকালীন সমাজের অদ্ভুত সামাজিকতার সাথে। যুদ্ধের সময় তিন সন্তান নিয়ে ছুটে বেড়ায় এখানে সেখানে। চাইলেই আর একটা বিয়ে করে সুখে সংসার করতে পারতো যে মানুষ টি সে তার পুরো জীবন টি উৎসর্গ করলো সন্তানদের জন্য।
মৃত্যুর রাতে দাদীর কবরে একা যাওয়ার জন্য সবাই আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায়! আমার মা আমার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে। অদ্ভুত বেপার! যে মানুষটির সাথে আমি জীবনের অর্ধেকটা সময় কাটিয়েছি তার কাছে আর যেতে পারবো না। সেই শিশুকাল থেকেই দাদীর কাছে থাকতাম। পুরো স্কুল জীবন দাদীর সাথে থাকা। দাদীর সাথে ঘুমানো, দাদী যেখানে যায় সাথে যাই। সেই মানুষের সাথে আমি আর একটি রাতও কাটাতে পারবো না। দাদীর শেষ ইচ্ছেটাও পূরণ করতে পারিনি। মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও দাদী আমার হাত ধরে বলছিল, "তুই একটা বউ নিয়ে আয় আমি দেখবো। বিয়েটা তাড়াতাড়ি কর, আমি মারা গেলে যেন তোর বউ অন্তত আমার লাশটা দেখতে আসতে পারে।"
দাদীকে আমি সবসময় 'বুবু' বলে ডাকতাম। সারাদিন হাতের কাজ করেতো দাদী। একটা সময় আমি দাদীর এই হাতের কাজগুলোতে সহযোগিতা করতাম। বৃদ্ধ বয়সেও এমনকি মৃত্যুর ক'দিন আগ পর্যন্তও তার উপার্জন ছিলো। নিজের টাকা দিয়ে নিজের ঔষধ কিনে খেতো। ছেলে মেয়েদেরও যা পারতো দিতো। নিজের জীবনকে উপভোগ করেনি, বিলাসিতা করেনি। মৃত্যুর ক'দিন আগেও এতোটা কষ্টের মাঝেও আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করে গেছে।
সময়ের পরিবর্তন হয়, মানুষের জীবন মানের পরিবর্তন হয়। কিন্তু আমাদের লোভের পরিবর্তন হয় না। সেটা আজও রয়ে গেছে তার পুরনো সে নিকৃষ্ট রূপে। বাড়ির বৃদ্ধ কেউ অসুস্থ হলেই শুরু হয় তার সম্পত্তির হিসাব নিকাশ। শুরু হয় সন্তানদের মধ্যে তাকে ভালো খাওয়ানোর প্রতিযোগিতা। আর মৃত্যুর পর ছেলে মেয়ের মধ্যে শুরু হয় সম্পত্তির ভাগ নেয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তারা এটা বোঝেনা যে মৃত্যুর আগেই এই বৃদ্ধ মানুষগুলো মরে যায় তাদের প্রতি আমাদের ব্যবহার দেখে!
একটা মানুষের মৃত্যু আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে যায়। কে সত্যিকার ভালোবাসতো আর কে স্বার্থের জন্য! সেই সাথে কিছু নষ্ট হওয়া সম্পর্ক আবার নতুন করে জোড়া লাগায়, আর কিছু ভালো সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।
"তাসের দেশে ঘর বেধেছি
জলছবি রং কাঁচে;
মৃত্যু?
সে-তো আকস্মিকেই বাঁচে!"
Comments
Post a Comment