নতুন রূপে "লাগান"- প্রথম আলো




দৈনিক প্রথম আলো
২২ জুন ২০১৭

নতুন রূপে "লাগান"
ভারতের নামী অভিনেতা আমির খানের খুব বিখ্যাত একটি সিনেমা "লাগান" দেখেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। সেখানে জমি লাগান নেওয়ার জন্য কৃষকদের নির্দিষ্ট হারে খাজনা দিতে হতো। যার মাত্রা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেতে থাকে। অনেকটা চক্রবৃদ্ধি সুদের মত। খাজনা নামের লাগামহীন সুদের অর্থ পরিশোধ কৃষকদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিতো।
আমাদের বাংলাদেশেও এক সময় "লাগান" শব্দটি পররিচিত ছিলো। কালক্রমে "লাগান" শব্দের রূপভেদ ঘটে, আর তা নতুন রূপে সমাজে লুকিয়ে যায়। আমরা মনে করি "লাগান" এর মাধ্যমে জমিদার-ইংরেজদের সেই কৃষক-শ্রমিক শোষণ এখন আর নেই। কিন্তু এর নতুন রূপটাকে আমরা চিনতে প্রতিনিয়ত ভুল করি। যার কারনে এটি ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচে কানাচে।
যেমনটা দেখলাম রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে। এখানকার নিম্নবিত্ত কৃষকরা বোরো এবং আউশ ধানের মৌসুমে অসাভাবিক চড়া সুদে অপর কোন উচ্চ কিংবা মধ্যবিত্তের কাছ থেকে অর্থ ধার করে থাকে। এই অর্থ সহজপ্রাপ্য এবং ঝামেলাহীন বলে কৃষকরা ব্যাংক বা পল্লী উন্নয়ন বোর্ড থেকে ঋণ নেওয়া এক রকম বন্ধ করে দিয়েছে। ব্রাক, আশা, ব্যুরো বাংলাদেশ এবং গ্রামীনব্যাংকের মতো কিছু এনজিও/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও তারা ঋণ নিয়ে থাকে। তবে এই ঋণে সুদের হার কম থাকে। ব্যক্তি বিশেষের কাছ থেকে তারা যে ঋণ নিয়ে থাকে তার আঞ্চলিক নাম "লাগান"। গ্রামের মাঝে এটি "টাকা লাগান দেওয়া" নামেই বেশি পরিচিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর সুদের মাত্রা ৫০ শতাংশেরও বেশি, এমনকি ১০০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে।
নিয়ামতপুর উপজেলার নুরপুর গ্রামে আত্মীয় থাকার সুবাদে সেখানে আমার এক সপ্তাহ থাকার সুযোগ হয়। এই এক সপ্তাহে আমি যা জানতে পারি তাতে বোঝা যায়- নুরপুর, চৌপুকুরিয়া, হাড়পুর, শালবাড়ি, টিএলবি সহ নিয়ামতপুর উপজেলার অন্তত ২০ টি গ্রামে "টাকা লাগান দেওয়া" নামক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি বৃহৎ আকার ধারণ করেছে এবং তা দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। নুরপুর গ্রামের অন্তত এগারোটি পরিবার এই সুদের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। শফিকুল ইসলাম নামের এক কৃষক ২০১২ সালে আশি হাজার টাকা লাগান নেয় মাত্র এক মাসের জন্য। মাসান্তে তাকে পরিশোধ হতো এক লক্ষ টাকা। কিন্তু এই অর্থ তিনি সময়মত পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। ফলশ্রূতিতে দুই বছর সুদ টেনে দেড় বিঘা জমি বিক্রি করে তাকে ঋণমুক্ত হতে হয়। ইসলাম হোসেন নামে একজন এই লাগানের কবলে পড়ে চার বছরে ছয় বিঘা জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ৭০ বছর বয়স্ক আলহাজ্ব রবিউল ইসলাম বলেন, "আমার পরিবারও লাগান টাকা লেনদেনের কবলে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। আমি গত এক বৎসর যাবৎ এই ব্যাধি থেকে বের হয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছি।"
শুধু তাই নয়, অনেকে লাগান নেওয়া টাকা পরিশোধ করতে না পেরে, পাওনাদারের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতেও বাধ্য হচ্ছেন। নিজস্ব ভিটা-মাটি হারিয়ে তাদের জায়গা হচ্ছে ঢাকা শহরের বস্তিতে। পার্শবর্তী উপজেলা মান্দা'তেও এধরনের অর্থ লেনদেন হচ্ছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিপদে পড়ে তারা যারা এটাকে ব্যাবসা হিসেবে গ্রহণ করে। অনেকে লাভের আশায় একজনের কাছ থেকে কম সুদে লাগান টাকা নিয়ে আর এক জনকে বেশি সুদে লাগান দেয়। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হয়ে তার প্রতিকূলে চলে যায়। দেখা যায়, তার লাগান গ্রহীতা টাকা নিয়ে উধাও। বাধ্য হয়ে নিজের জমি বিক্রি করে পাওনাদারের অর্থ পরিশোধ করতে হয়। ঐ উপজেলার হাড়পুর গ্রাম থেকে এমন অন্তত পাঁচ জন টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। তবে ইতিপূর্বে এই লেনদেন করা হতো যথা সম্ভব গোপনে। বর্তমানে টাকা লাগান দেওয়া-নেওয়া প্রকাশ্য ঘটনা। এভাবে চলতে থাকলে নুরপুর গ্রামের মতো এই সামাজিক ব্যাধি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। আর নিঃস্ব করবে শত শত সাধারন সহজ-সরল কৃষককে। যার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এবং দেশকে নিম্ন-মধ্যম থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত করার স্বপ্ন ধরে রাখতে এ ধরনের সামাজিক ব্যাধি শক্ত হাতে দমন করা উচিৎ। আশা করি কতৃপক্ষ যথাযথ এবং সময়োচিত পদক্ষেপ নেবেন।

ধন্যবাদ।
রেজাউল হক
নওগাঁ, রাজশাহী।
reza4206@yahoo.com

Popular posts from this blog

সেকায়েপ শিক্ষকদের দৈন্যদশা-সমকাল

উদ্যোগ নেওয়া জরুরি নয় কী?- কালের কন্ঠ

একদিন স্বপ্নের দিন